“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অগাধ রিজিক দেন, আবার যাকে ইচ্ছা সীমিত করেন।”
— (সূরা রা’দ: ২৬)
প্রতিদিন আমরা নিজেরা অথবা আমাদের আশপাশের মানুষদের একটি সাধারণ প্রশ্ন করতে শুনি—
“আমি এত পরিশ্রম করছি, তবুও আয় কেন বাড়ছে না?”
“সারাদিন দৌড়াচ্ছি, তারপরও সংসারে টানাপোড়েন।”
“আমার চেনাজানা কেউ খুব কম কাজ করেও অনেক আয় করছে—কেন?”
এই প্রশ্নগুলো শুধুই অর্থনৈতিক বাস্তবতা নয়; বরং এগুলো আসমানী রিজিক দর্শনের অন্তর্নিহিত অনুসন্ধান।
রিজিকের ভুল ব্যাখ্যা ও সাধারণ ধারণা
আমরা অনেকেই মনে করি—রিজিক মানে শুধু টাকা-পয়সা। যিনি লাখ টাকা ইনকাম করছেন, তাকেই আমরা ‘সফল’ বলি। অথচ কুরআনের আলোকে রিজিক মানে শুধু আয় নয়, বরং—
- খাবার, পানি, বস্ত্র, ঘর
- স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তি
- সন্তান, সময়, জ্ঞান
- এমনকি সুযোগ—এসব কিছুই রিজিক
“আকাশ ও পৃথিবীতে তোমাদের জন্য যা কিছু আছে, সবই তিনি তোমাদের উপকারের জন্য নিয়োজিত করেছেন।”
— (সূরা জাসিয়া: ১৩)
সুতরাং কেউ কম আয় করলেও যদি মানসিক শান্তি, হালাল খাদ্য ও রোগমুক্ত জীবন ভোগ করেন—তাহলে তাকেও বলা যায় ‘রিজিকপ্রাপ্ত’।
রিজিক শুধু পরিশ্রমে নির্ভর করে না
আমরা সাধারণত বলি—“কাজ করলে আয় হবেই”। হ্যাঁ, আল্লাহ কুরআনে বলেছেন:
“মানুষ কিছুই পাবে না, তবে সে যা চেষ্টা করে।”
— (সূরা নজম: ৩৯)
তবে একইসাথে কুরআন বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—ফলাফল নির্ধারণকারী মূল কর্তৃত্ব আল্লাহর।
“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রিজিক বাড়িয়ে দেন, আবার যাকে ইচ্ছা সংকুচিত করেন।”
— (সূরা শূরা: ১২)
সুতরাং চেষ্টা অবশ্যই জরুরি, তবে চেষ্টা থাকলেই অটোমেটিক ফল মিলবে—এমন ধারণা কুরআনের দৃষ্টিতে অসম্পূর্ণ।


রিজিকের পথে কি সমস্যা হচ্ছে? কুরআনের দৃষ্টিতে কিছু সম্ভাব্য কারণ
১. রিজিকের পথ হালাল না হওয়া
আয় যদি সন্দেহজনক বা হারাম উৎস থেকে হয়, তাতে বরকত থাকে না—even যদি আয় বেশি হয়।
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা হালাল ও পবিত্র জিনিস খাও যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি।”
— (সূরা বাকারা: ১৭২)
আল্লাহ হারাম পথে রিজিককে দেননি—সে পথে গেলে আপনি নিজের রিজিকের বরকত নষ্ট করছেন।
২. শুকরিয়া না করা ও অতৃপ্ত মনোভাব
কুরআনে বলা হয়েছে, যারা শুকরিয়া করে—তাদের জন্য আল্লাহ রিজিক বাড়িয়ে দেন।
“তোমরা কৃতজ্ঞ হলে আমি তোমাদের জন্য আরো বাড়িয়ে দেব।”
— (সূরা ইব্রাহিম: ৭)
কিন্তু আজকের যুগে আমরা যা পাই, তাতেই অখুশি। এই অখুশির ফলেই অনেক সময় রিজিক আটকে যায়।
৩. নিয়মিত গুনাহ করা ও আত্মশুদ্ধির অভাব
দুনিয়ার পাপ রিজিকের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
“তোমাদের যে বিপদ এসেছে, তা তোমাদের কৃতকর্মের ফল।”
— (সূরা শূরা: ৩০)
দায়িত্বহীন জীবনযাপন, মিথ্যা, প্রতারণা, অন্যায় আয়ের চেষ্টা ইত্যাদি একেকটি রিজিক আটকে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
৪. পরীক্ষা হিসেবে রিজিক সীমিত রাখা
সব সময় কম রিজিক মানেই গুনাহের ফল নয়—এটা হতে পারে আপনার জন্য পরীক্ষা ও পরিশুদ্ধি।
“আমি তোমাদেরকে সামান্য ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ঘাটতি দিয়ে পরীক্ষা করব।”
— (সূরা বাকারা: ১৫৫)
মুমিনদের জন্য রিজিক কমে যাওয়া মানে আল্লাহ তাকে নতুন করে গড়ে তুলছেন।
৫. অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে হিংসা
কারও বেশি রিজিক মানেই সে সফল—এই ধারণা আত্মঘাতী।
“তোমরা পরস্পর একে অপরের মধ্যে ঈর্ষা করো না।”
— (সহীহ মুসলিম)
কারও বেশি আয় দেখা মানেই তার জীবন ভালো নয়। হয়তো সে অন্যায় পথে চলছে, বা হয়তো সে বড় পরীক্ষার মধ্যে আছে।
৬. দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যাই বড় সমস্যা
আমরা আয় না বাড়লেই ধরে নিই—‘আমার রিজিক আটকে গেছে’। অথচ হয়তো রিজিক আসছে—
- অন্যভাবে
- অন্যসময়
- বা এমন কিছু থেকে আপনাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে, যা আপনি জানেন না
তাহলে করণীয় কী?
✅ ১. নিজের রিজিকের অবস্থান নির্ধারণ করুন
উপরে বলা ৭ ধরণের রিজিকের মধ্যে আপনি কোন পর্যায়ে আছেন—এটা বিশ্লেষণ করুন।
✅ ২. কুরআনের সার্বজনীন বিধান মেনে চলুন
- হালাল-হারাম নিয়ে সচেতন হন
- প্রতিদিন কিছু কুরআন পড়ুন, বুঝুন
- জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে আল্লাহর নিয়ম অনুসরণ করুন
✅ ৩. ভরসা বাড়ান
“যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।”
আজকে আপনার আয় কম—কিন্তু আপনি যদি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যান, একদিন হয়তো এমন দরজা খুলে যাবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারেন না।
✅ ৪. মানুষের উপকারে আসার চেষ্টা করুন
যে যত মানুষের উপকার করেন, তার রিজিক তত বিস্তৃত হয়—চাপ কমে, বরকত বাড়ে।
✅ ৫. দুয়া ও তাওবা চালিয়ে যান
যদি মনে হয়, আপনি ভুল পথে ছিলেন বা আল্লাহকে ভুলে গেছেন—তাহলে এখনই তাওবা করুন।
“তোমার প্রভুর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।”
— (সূরা যুমার: ৫৩)
“আমার ডান হাতে যদি চাঁদ 🌙 এবং বাম হাতে সূর্য ☀️ এনে দেওয়া হয়, তবুও আমি সত্যের পথ ত্যাগ করবো না।” — রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
শেষ কথা
আপনি হয়তো ইনকামে পিছিয়ে আছেন, জীবন জটিল মনে হচ্ছে। তবে এটাও হতে পারে—আল্লাহ আপনাকে প্রস্তুত করছেন, ভালো কিছু দেওয়ার আগে শুদ্ধ করছেন।
সঠিক রিজিকের জন্য শুধু চেষ্টা নয়—বিশ্বাস, সততা, ও আসমানী বিধানের প্রতি আনুগত্য অপরিহার্য। মনে রাখুন, যিনি পাখিকে আকাশে উড়তে দেন, পোকাকে মাটির নিচে রিজিক দেন—তিনি আপনার রিজিকও ঠিকই নির্ধারণ করে রেখেছেন।
“আসমানে রয়েছে তোমাদের রিজিক এবং যা তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।”
— (সূরা যারিয়াত: ২২)
সুতরাং, হতাশ হবেন না। বরং নিজেকে পরিশুদ্ধ করুন, জীবনদর্শন গড়ুন এবং ধৈর্য ও ভরসা নিয়ে এগিয়ে যান। ইনশাআল্লাহ, রিজিক সহজেই আপনার পথ খুঁজে নেবে।